নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই ঘটছে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। অধিকাংশ ঘটনাতেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে মানুষ। ফলে গণপিটুনির মতো আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। গত রোববার রাতেও সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের বাঘরী গ্রামে গণপিটুনিতে চার ডাকাত নিহত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্টজন বলছেন, অপরাধী হলেও কাউকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা ভয়াবহ আলামত। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করছে।
বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মতো সমস্যা। কিন্তু নানা কারণে মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ভরসা করতে পারছে না। ফলে মাঝে মাঝেই তারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। রোববার রাতে সোনারগাঁয়ের বাঘরীর যে এলাকায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটে, সেখানে একটি বড় বিল রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ বন্দর ও সোনারগাঁ উপজেলার তিন ইউনিয়ন ছুঁয়েছে এই বিল। এর দক্ষিণ ও পশ্চিমে বন্দরের মদনপুর, উত্তরে কাঁচপুর ইউনিয়ন ও পূর্বে সাদিপুর ইউনিয়ন। বিলের চারদিকে এসব ইউনিয়নের পনেরোটির বেশি গ্রাম। বাঘরী এলাকার বাসিন্দা রহমত উল্লাহ বলেন, এই বিলের চারদিকের গ্রামগুলোতে প্রায়ই চুরি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এ জন্যই গত রোববার রাতে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। সোনারগাঁর মহজমপুর গ্রামের বাসিন্দা ইয়াসিন মিয়া বলেন, সোনারগাঁয়ে গণপিটুনিতে যে চারজন নিহত হয়েছে, তাদের একজন জাকির হোসেন। তার বিরুদ্ধে ডাকাতির ১০টি মামলা আছে। ২০২২ সালের ৩ মার্চ সোনারগাঁয়ের সাদিপুর গ্রামের নানাখি এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে জাকির আর তার দুই সঙ্গী গণপিটুনির শিকার হয়। গত বছর মহজমপুর গ্রামে এক পুলিশ পরিদর্শকের বাড়িতে ডাকাতি করার পর গ্রেপ্তার হয়েছিল জাকির। কিন্তু পরে জামিনে বেরিয়ে আসে। শীতের সময় সোনারগাঁয়ে গত এক মাসে অন্তত ১১টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, মাস দুয়েক আগে সোনারগাঁয়ের বারদী ও নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা ডাকাতি প্রতিরোধে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। নোয়াগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান সামসুল আলম সামসু ও বারদী ইউপি চেয়ারম্যান লায়ন মাহবুবুর রহমান বাবুল ডাকাতি প্রতিরোধে বিভিন্ন এলাকায় পাহারারও ব্যবস্থা করেন। তবু ডাকাতি ঠেকানো যায়নি। সোনারগাঁর মতো ২০২৩ সালের অক্টোবরে পার্শ্ববর্তী উপজেলা আড়াইহাজারে ১০ দিনে আট বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, এসব ডাকাতির ঘটনায় অতিষ্ঠ মানুষ পুলিশের কাছে যান কম। বরং ডাকাতদের গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করাকেই তারা সমাধান মনে করছেন। ২০১৫ সালে আড়াইহাজারের পুরিন্দায় গণপিটুনিতে আটজন নিহত হয়। বাঘরী বিলেই ডাকাতির অভিযোগে ২০১৬ সালে গণপিটুনিতে মারা যায় আরেকজন। ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জে পাঁচ বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগে গণপিটুনিতে একজনকে হত্যা করা হয়। এ বছরের ২২ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জে চুরির অভিযোগে মিলন নামে এক যুবককে হাত-পায়ের রগ কেটে ও পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যদিও মিলনের পরিবারের অভিযোগ, পূর্বশত্রুতার জেরে মিলনকে হত্যা করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সব ক্ষেত্রে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হওয়া মানুষকে অসহিষ্ণু করে তুলছে বলে মনে করেন সোনারগাঁয়ের বাসিন্দা কবি শাহেদ কায়েস। সোনারগাঁর ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রোজার দিন, মানুষের সংযমী হওয়ার কথা। ডাকাতি করতে এসে থাকলে তাদের পুলিশে দেওয়া যেত। কিন্তু তা না করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যা সমর্থনযোগ্য নয়। যারা এই চারজনকে হত্যা করেছে, দেখা যাবে তারা সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। অর্থনৈতিক একটা চরম দুরবস্থা চলছে। সরকারি চাকরিজীবী আর ক্ষমতার কাছাকছি থাকা লোকজন ছাড়া বাকিরা ভালো নেই। মানুষ তার ক্ষোভও প্রকাশ করতে পারছে না। এসব কারণে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি সমাজে কিশোর গ্যাং ও ডাকাত দল তৈরি করছে। আবার এই পরিস্থিতিই মানুষের মধ্যে ডাকাতকে আইনের কাছে সোপর্দ না করে তৈরি করছে পিটিয়ে হত্যা করার প্রবণতা। মানুষ আইনি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নিজের বিচারের ওপর বেশি ভরসা করছে। কারণ তাদের আইনি প্রতিষ্ঠানের ওপর ভরসা নেই।’
একই ধরনের মন্তব্য করেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রফিউর রাব্বি। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট চরম পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট। কোনো অপরাধীর যে বিচার হবে, সেটার জন্য আইনের ওপর মানুষ ভরসা করতে পারছে না। একজন ডাকাত বা যেই হোক, তারও বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। এভাবে হত্যা দুঃজনক। এটা ভয়াবহ আলামত। যে কোনো সময় এ ধরনের ঘটনার শিকার কোনো নিরীহ মানুষও হতে পারে।তবে মানুষ পুলিশের মতো আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভরসা হারাচ্ছে– মানতে নারাজ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল। তাঁর দাবি, পুলিশের ব্যবস্থার কারণেই এক সময়ের ডাকাতিপ্রবণ এলাকা আড়াইহাজারসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি কমে এসেছে। কোথাও চুরি-ডাকাতি হলে পুলিশ মামলা নিচ্ছে, আসামি ধরছে; তাদের সাজাও হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ তাদের কাজ করে যাচ্ছে।